অন্তর
আমি প্রস্তুত ৷
বিশাল সমুদ্র ৷ ভয়ংকর শব্দ ৷ জলের উথাল পাথাল, এক মুহূর্তে শেষ ক’রে দেবার হুমকি ৷ ভয়, আশঙ্কা নিয়ে আমি টিউবে ভাসছি ৷ নোন্তা জল আমার মুখের ফুটোগুলো দিয়ে ঢুকছে ৷ তার ওপর ফেনার দুর্গন্ধ ৷ আমার চোখ জলছে ৷ আমি জলে রসাতল ৷ চান্চল্য আর শব্দের মধ্যে আমি একবার এদিক আর একবার ওদিক করছি ৷ এত অনাশ্চিতের মধ্যেও একটা আনন্দ হ’চ্ছে – আমি যে কত হাল্কা তা ডাঙায় কখন বুঝতে পারিনি ৷ কোনটা সত্যি? আমার ডাঙার ভার না চন্চল সমুদ্রের তূলবৎ তরলঙ আধার? কিছুদিন আগে যখন প্রথম প্লেনে চড়েছিলাম তখন আমি আমাকে একই প্রশ্ণ করেছিলাম ৷ A নয়ত F কোন একটা দিক থেকে মাটিতে থাকা প্লেনের বাইরে দিয়ে আকাশটাকে কাল্পনিক মনে হয়েছিল, কিন্তু মাটি ছেড়ে উড়তে উড়তে যখন বাড়ি ঘর ছোট হ’য়ে আসতে লাগল, হল বিন্দুবৎ, তখন তুলোর মত মেঘে ঢাকা আকাশটাকে সত্যি আর আমার ফেলে আসা শহরকে কাল্পনিক ম’নে হ’য়েছিল ৷ তখনও ভেবেছিলাম কেন আমাদের মাঝে মধ্যে দূরের থেকে নিজের ঘরবাড়ি দেখা উচিৎ ৷ আকাশ থেকে অট্টালিকাও যা কুঁড়েঘরও তা ৷ পার্থক্যে ঘিরে থাকা স্থলে থেকে তা জানা বড় মুশকিল ৷ আকাশে উড়লে বা জলে ভাসলে তা দেখা যায় ৷
সমুদ্রে আসার আগে ট্রেনিঙ নিতে হয়েছিল ৷ তাই জানি কি ক’রে ডুবতে হয় ৷ তাই ডুব দিলাম ৷ ডুব দিতে দিতে একেবারে চলে গেলাম সমুদ্রের স্থলে ৷ সমুদ্রের স্থল? তবে যে জানতাম একভাগ জল আর তিনভাগ স্থল? নাঃ এসব ভাবব না ৷ আমি এসব ভাগাভাগির মধ্যে নেই, সত্যি মিথ্যের ভিড়েও নই ৷ এত হাল্কা সৌন্দর্য্যের মধ্যে সবকিছুই চিরন্তন ম'নে হ'চ্ছে ৷ কত মাছ, কত গাছ, কত নানান রকমের জীবন ৷ কী অদ্ভূত সুন্দর
তাদের ধরনধারন, সবাই স্বচ্ছ, স্তব্ধ আর স্নিগ্ধ ৷ আমার ঢাকা চোখ, বন্ধ নাক আর স্তব্ধ কান দিয়ে সমুদ্রের নিয়ম জানলাম ৷ বাইরে চন্চল সমুদ্র, ভিতরে শান্ত, স্নিগ্ধ, বাইরে চীৎকার, হুমকি, শব্দ, ভিতরে আস্থা, স্থিতি, নিঃশব্দ ৷ কোন শব্দ নেই, এমনকি আমার নিঃশ্বাসেরও না – শুধু দেখতে পাচ্ছি তারা বুদবুদ ক’রে ওপরে যাচ্ছে আমার খবর দেবার জন্য আর নল দিয়ে নীচে আসছে ওপরের খবর নিয়ে খাকিবেশ পরা পোস্টম্যানের মত ৷ আমি ভাসছি...মনে হ’চ্ছে যেন নিজের ভিতরেই আছি, যেন এরকম ভাসার অভ্যাস আমার আছে ৷ তখনও নল ছিল, তবে নাকে বোধহয় না, অন্য কোথাও হবে ৷ সমুদ্রের একেবারে নীচে এসে আমার ছোটবেলার একটা সুর ভেসে এল ৷ দূর থেকে গানের মত মনে হ’চ্ছে ৷ শীতের ছুটিতে যখন দুপূরবেলা খেতে বসতাম, রোজ দুট ফেরিওয়ালা যেত ৷ আমি ডালভাত খাবার সময় শুনতাম ‘জয়নগরেএএএএর মোয়াঃ’ আমার মাছভাত খাবার সময় শুনতাম ‘ঢাকাআআআই ক্ষীঈঈঈঈর’ ৷ আমার খাবারের সাথে এই ডাকগুলো যে সূর হ’য়ে মিশে আছে তা জানতে পারলাম সমূদ্রের নীচে এসে ৷ It seemed waters were breaking and I was settling down.
এবার ওপরে ওঠার পালা ৷ চোখ বন্ধ ক’রে ভাবছি এখানে আর কখন কি আসতে পারব ! নিলাম যত সম্পদ, যত শান্তি, যত অচন্চলতা নিঃশব্দে…আমার ঘর্মাক্ত শরীরে ৷ আলতো ক’রে ভেসে উঠলাম ওপরে, এখন জলের উথালপাথাল হুমকি ব’লে মনে হ’চ্ছেনা ৷
দূরে ডাঙা দেখা যাচ্ছে ৷
আমি আমার মুখোশ খুলব ব’লে প্রস্তুত হ’চ্ছি ৷